ক্যাবিনেটের নতুন জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা: ৫০০টি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রের লক্ষ্য
সংক্ষিপ্তসার
ক্যাবিনেট প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, যার মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে ৫০০টি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হবে এবং প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। পরিকল্পনা দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্ষমতা বাড়াবে, জীবনহানি কমাবে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাস করবে। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বয়ে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।
বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এই পরিকল্পনা দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোকে আধুনিকায়ন এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। পরিকল্পনার অনুমোদনকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটি দেশের দুর্যোগপ্রবণ ভূগোলিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি কৌশলগত উদ্যোগ। পরিকল্পনার আওতায় নির্মিত কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক সেবা ও প্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত করা হবে, যাতে জরুরি অবস্থায় দ্রুত সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়।
পরিকল্পনার মূল ধারা অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে মোট পাঁচশোটি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। প্রতিটি কেন্দ্রকে কমপক্ষে দুইশোজন মানুষকে একসাথে সামলাতে সক্ষমভাবে নকশা করা হবে এবং বন্যা, সুনামি, ঝড়-তুফান ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের দুর্যোগের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো থাকবে। এই প্রকল্পের মোট বাজেট প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা নির্ধারিত, যা সরকারী ও বেসরকারি তহবিলের সমন্বয়ে গৃহীত হবে। প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে জরুরি চিকিৎসা শিবির, খাবার সংরক্ষণাগার এবং যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে, যাতে দুর্যোগের সময় মৌলিক সেবা অবিলম্বে প্রদান করা যায়।
নির্মিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে উচ্চমানের রেইনফোর্সড কংক্রিট ও স্টিল ফ্রেম দিয়ে নির্মাণ করা হবে, যাতে বন্যা ও ভূমিকম্পের সময় কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে স্বয়ংক্রিয় জেনারেটর, সোলার প্যানেল এবং পানি শোধন ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে, যা বিদ্যুৎ ও পানির ঘাটতি মোকাবিলায় সহায়ক হবে। এছাড়া, ডিজিটাল জরুরি সতর্কতা সিস্টেম এবং রেডিও যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে সময়মতো তথ্য প্রদান করা সম্ভব হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে বিশেষভাবে ডিজাইন করা নার্সারি ও শিশু সুরক্ষা কক্ষ থাকবে, যাতে দুর্যোগের সময় সবচেয়ে দুর্বল গোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. হাবিবুল হক জানিয়েছেন, 'এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং জীবনহানি কমবে।' তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, পরিকল্পনার তহবিলের একটি অংশ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহায়তায় সংগ্রহ করা হবে, যা প্রকল্পের দ্রুত অগ্রগতিতে সহায়তা করবে। এছাড়া, মন্ত্রণালয়টি স্থানীয় সরকার ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে। প্রকল্পের অগ্রগতি মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশ করা হবে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তৃতীয় পক্ষের অডিটিং সংস্থার সহায়তা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ, যেখানে বার্ষিক বন্যা, সুনামি, চক্রবাতি ঝড় এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র বৃষ্টিপাতের ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ২০২২ সালে বন্যা ও সুনামি একসাথে দেশজুড়ে ১,২০০ টিরও বেশি পরিবারকে প্রভাবিত করে, আর ২০১৯ সালের চক্রবাতি ঝড়ে ৩,৫০০ টির বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী ও বেসরকারি সংস্থাগুলি দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশল গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে। এ পর্যন্ত গৃহীত অস্থায়ী শেল্টার ও স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্কগুলো যদিও সহায়ক ছিল, তবে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সমাধানের অভাব স্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে দুর্যোগের সময় মানবিক ক্ষতি কমে যাবে এবং পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে। স্থানীয় ব্যবসা ও কৃষকদের জন্য স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে, কারণ তারা দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ক্ষতি সীমিত করতে পারবে। এছাড়া, প্রশিক্ষিত কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী দলগুলোকে কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করে সম্প্রদায়ের সচেতনতা ও প্রস্তুতি বাড়ানো যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দুর্যোগের অর্থনৈতিক ব্যয় কমাবে। প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন দেশের আন্তর্জাতিক চিত্রকে শক্তিশালী করবে এবং ভবিষ্যতে দুর্যোগ সহায়তা তহবিলের জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সহায়তা করবে।
পরিকল্পনার প্রথম ধাপের কাজ আগামী মাসের মধ্যে শুরু হবে, যেখানে প্রথম ৫০টি আশ্রয় কেন্দ্রের নকশা ও স্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সরকার স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে সময়সূচি মেনে চলার জন্য একটি তদারকি কমিটি গঠন করেছে। সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই উদ্যোগটি দেশের দুর্যোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করবে বলে আশা করা যায়। এই উদ্যোগের সাফল্য দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।