সম্পাদক: মো: রাসেল
বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন যুগ: ৫০০টি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র পরিকল্পনা
সর্বশেষ

বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন যুগ: ৫০০টি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র পরিকল্পনা

Md Rashaduzzaman
৬ নভেম্বর, ২০২৫, ২:০৩ PM
৫ বার পঠিত

বাংলাদেশের ক্যাবিনেট আজ সন্ধ্যায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য একটি জাতীয় পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এই সিদ্ধান্তটি দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। পরিকল্পনাটি পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০০টি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। সরকার এই উদ্যোগের মাধ্যমে দুর্যোগের সময় মানবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।

পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রকে আধুনিক সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে নির্মাণ করা হবে, যাতে বন্যা, সাইক্লোন ও ভূমিকম্পের মতো বিভিন্ন প্রকারের দুর্যোগে কার্যকর সুরক্ষা প্রদান করা যায়। কেন্দ্রগুলোতে জরুরি চিকিৎসা সুবিধা, খাবার সংরক্ষণ গুদাম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। এছাড়া, স্থানীয় কমিউনিটিকে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা হবে।

পাঁচ বছরের সময়সীমার মধ্যে মোট ৫০০টি আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে, যার মধ্যে ২০০টি সাইপ্রাস নদীর তীরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এবং ৩০০টি উপকূলীয় সাইক্লোন প্রবণ অঞ্চলে হবে। প্রতিটি কেন্দ্রের গড় ক্ষমতা প্রায় ১,৫০০ জন মানুষকে সাময়িকভাবে আশ্রয় প্রদান করতে সক্ষম হবে। নির্মাণ কাজের জন্য সরকার বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করেছে, যা প্রাথমিকভাবে ১.২ ট্রিলিয়ন টাকার বেশি হবে। এই তহবিলের অংশ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে।

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হবে: পরিকল্পনা ও নকশা, নির্মাণ ও সরঞ্জামায়ন, এবং পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ। প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি এলাকার ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত সাইট নির্বাচন করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থানীয় শ্রমিক ও কন্ট্রাক্টরদের নিয়োগ দিয়ে দ্রুত নির্মাণ নিশ্চিত করা হবে। তৃতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত কর্মী দল গঠন করে আশ্রয় কেন্দ্রের দৈনন্দিন কার্যক্রম ও জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ছাড়াও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, এবং স্থানীয় সরকার সংস্থা এই প্রকল্পে সমন্বিত ভূমিকা পালন করবে। তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল মানচিত্র ও রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণ সিস্টেম সরবরাহ করবে, যা আশ্রয় কেন্দ্রের ব্যবহার ও প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণে সহায়তা করবে। এছাড়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জরুরি চিকিৎসা সেবা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করবে। এই সমন্বিত পদ্ধতি দুর্যোগের সময় দ্রুত ও কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. রুবেল হোসেন পরিকল্পনাটিকে 'দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা গ্যারান্টি' হিসেবে প্রশংসা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, '৫০০টি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা শুধু শারীরিক সুরক্ষা নয়, বরং কমিউনিটির আত্মবিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা বাড়াবে।' আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ ও রেড ক্রসও এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে সহায়তা ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করবে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও ধারাবাহিক রক্ষণাবেক্ষণের উপর।

আশ্রয় কেন্দ্রের স্থাপন গ্রামীণ ও নগর দু'প্রান্তের দুর্যোগপ্রবণ জনগণের জন্য সরাসরি উপকার বয়ে আনবে। বন্যা মৌসুমে নদীর তীরবর্তী পরিবারগুলো দ্রুত নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরিত হতে পারবে, ফলে প্রাণহানি ও সম্পত্তি ক্ষতি কমবে। সাইক্লোনের সময় উপকূলীয় শহরগুলোতে তীব্র বায়ু ও বৃষ্টির প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে। দীর্ঘমেয়াদে এই অবকাঠামো স্থানীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনেও সহায়তা করবে, কারণ পুনরায় বসতি স্থাপন ও ব্যবসা চালু করা সহজ হবে।

বাংলাদেশের এই জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলো ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে দুর্যোগ প্রস্তুতি ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক দাতাদের দৃষ্টিতে এই উদ্যোগটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা গ্লোবাল রেজিলিয়েন্স ফ্রেমওয়ার্কের অংশ। ভবিষ্যতে, এ ধরনের সমন্বিত পরিকল্পনা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শেয়ার্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্টকে আরও শক্তিশালী করবে।

ক্যাবিনেটের এই সিদ্ধান্ত দেশের দুর্যোগ প্রস্তুতিকে নতুন মাত্রা দেয়ার প্রতিশ্রুতি বহন করে। পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আগামী পাঁচ বছর এই প্রকল্পের অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে, এবং প্রয়োজনমতো সমন্বয় করা হবে। শেষ পর্যন্ত, ৫০০টি নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র দেশের মানবিক নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

শেয়ার করুন:

মন্তব্য (0)

এই পোস্টে এখনও কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!